চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আনন্দ-বেদনার কাব্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের প্রধান বাহন শাটল ট্রেন। এই শাটল ট্রেন ঘিরে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর নানান রঙের স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও এই স্মৃতি কেউ ভুলতে পারেন না এবং ভুলতে চান না।
ঐতিহ্যের এই শাটল ট্রেনে বহুকাল পর এবার যুক্ত হতে চলেছে পাওয়ার কার। এতোদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ট্রেনটিতে পাওয়ার কার না থাকায় বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস ও বাল্বের আলো থেকে ছিলেন বঞ্চিত। ফলে চরম দুর্ভোগ স্বীকার করেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হতো।
বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন উপাচার্য ড. মো. আবু তাহের দায়িত্ব গ্রহণের পর শাটল ট্রেনে পাওয়ার কার এবং আরো কিছু বগি যুক্ত করার উদ্যোগ নেন। তারই ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মিটিং করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এসময় একটি পাওয়ার কার ও বগি বাড়ানোর প্রস্তাব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি।
গত ১৬ মে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় (সিআরবি) কার্যালয়ে প্রধান বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী (পূর্ব) মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে এই আলোচনা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির।
শাটল ট্রেনের ইতিবৃত্ত
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটলের সার্ভিস শুরু হয় ১৯৮০ সালে। শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ২২ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রধান মাধ্যম এই ট্রেন। এই ট্রেনে চেপে প্রতিদিন ১০-১২ হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করেন। বিশ্বের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শাটলের ব্যবস্থা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা থাকলেও কয়েক বছর আগে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সবুজঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসই এখন বিশ্বে একমাত্র শাটলের ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় ৪৪ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের বয়ে বেড়ানো এ শাটল যেন কালের সাক্ষী ও বহু ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।
ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার পথে পুরোটা সময়জুড়ে আড্ডা-গানে মুখর থাকে শাটলের সব বগি। রক-র্যাপের পাশাপাশি জারি-সারি, ভাটিয়ালি, প্যারোডি, পাহাড়ি, বাংলা সিনেমার গান ও লোকগানে সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে তুলেন শিক্ষার্থীরা। বগি চাপড়িয়ে শিক্ষার্থীদের গানে মেতে ওঠে শাটল। ট্রেনের প্রতিটি বগির সিট ও পাটাতন শিক্ষার্থীদের গল্প-আড্ডা, খুনসুটি আর গানে গানে জেগে থাকে সারাটি পথ। এ শাটলের বগির দেয়াল ও সিটকে ঢোল-তবলার মতো চাপড়িয়ে গান গেয়ে দেশবরেণ্য শিল্পীর খ্যাতিও কুড়িয়েছেন অনেকেই।
শাটল ট্রেনকে কেন্দ্র করেই আবতির্ত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা ও আনন্দ-বেদনার একেকটি মহাকাব্য। এ মহাকাব্যের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘শাটল ট্রেন’। এটি নির্মাণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৪তম ব্যাচের চারুকলা বিভাগের ছাত্র ও চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রদীপ ঘোষের পরিচালনা এবং ৩৪তম ব্যাচের ফাইন্যান্স বিভাগের রিফাত মোস্তফার সহকারী পরিচালনায় এতে অভিনয় করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬তম ব্যাচের ছাত্রী মোহসেনা ঝর্ণার ‘বহে সমান্তরাল’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রেম-ভালোবাসা, বিচ্ছেদ ও শিক্ষাঙ্গনের নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।
শাটলকে ঘিরে আবেগ ভালোবাসা থাকলেও রয়েছে শিক্ষার্থীদের হতাশার ক্ষোভ। বর্তমানে ২টি শাটল ট্রেন প্রতিদিন মোট ১৪ বার শহর-ক্যাম্পাস-শহর আসা যাওয়া করে। প্রতিটি শাটলে দশটি করে বগি আছে। ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর যাতায়াতে যা খুবই অপ্রতুল। প্রতি বছর জ্যামিতিক হারে শিক্ষার্থী বাড়লেও বাড়েনি শাটলের শিডিউল ও বগি। এতে ভোগান্তির শিকার হাজারো শিক্ষার্থী। প্রতিদিন গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করেন শিক্ষার্থীরা। পাওয়ার কার না থাকায় ফ্যান থাকলেও তা চলে না। অধিকাংশ বগির লাইটও নষ্ট। এই তীব্র গরমে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করে অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
ছাত্র-শিক্ষকদের কথা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সম্মান শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসলিম হাসান বলেন, শহর থেকে ২২ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে আসতে হয়। শাটলে বগি সংকটের কারণে শত শত শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে কেউবা ঝুলিয়ে ক্লাসে আসে। ক্লাস শেষে ক্লান্ত শরীরে আবার যুদ্ধ করতে হয় শাটলে সিট পাওয়ার জন্য। এতো তাপদাহে আমাদের পক্ষে এভাবে যাতায়াত অনেক কষ্টের। যাতায়াতের জন্য শাটলের বগি বৃদ্ধি ও ডেমু ট্রেন চালুর বিকল্প নেই।
উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সম্মান ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী উম্মে সালমা নিঝুম বলেন, শাটল ট্রেনে যাতায়াত করতেই সবাই সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ, একেতো ভাড়া লাগে না তার উপর আড্ডা দিয়ে, গান গেয়ে, মজা করে ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসা করতে পারেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পর্যাপ্ত সিট না থাকায় যাদের দাঁড়িয়ে চলাচল করতে হয়, তাদের জন্য এই আনন্দ বিস্বাদে পরিণত হয়।
শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও শাটল বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, আমরা শাটলের ফ্যানগুলো মেরামত করব। প্রতিটি শাটলে পাওয়ারকার যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপও হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব তা বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া আবারও ডেমু ট্রেন চালু করা যায় কিনা আমরা সে বিষয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন বলেন, চবি’র শিক্ষার্থীরা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র শিক্ষার্থী, যারা তাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য শাটল ট্রেনের অ্যাক্সেস পায়। কিন্তু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে তা উল্লেখযোগ্য বৈষম্য প্রকাশ করে। ক্যাম্পাসের শান্ত পরিবেশ সত্ত্বেও শাটল ট্রেনের যাত্রা অস্বস্তি, অত্যধিক ভিড় এবং দীর্ঘ অপেক্ষা, অনিরাপত্তা, রাজনৈতিক সহিংসতা তাদের অসহায় করে তোলে। এই কঠিন অভিজ্ঞতা সম্পদ এবং অবকাঠামোর অ্যাক্সেসের ক্ষেত্রে বৃহত্তর বৈষম্যকে তুলে ধরে, যা শিক্ষার্থীদের মঙ্গল এবং অ্যাকাডেমিক কর্মক্ষমতাকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক সাধনায় সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত করার জন্য আরামদায়ক পরিবহন অপরিহার্য। একটি চ্যালেঞ্জিং যাতায়াত মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি অ্যাকাডেমিক সাফল্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
ড. আলা উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য এই শাটল ট্রেন পরিষেবার উন্নতিতে, বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের অভিজ্ঞতার বৈষম্য দূর করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবান্ধব এই শিক্ষক আরো বলেন, এই ডিজিটাল যুগে প্রতিদিনের কষ্টকর যাতায়াত ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনাকে পরোক্ষভাবে চ্যালেঞ্জ করে। মূল্যবান সময় এবং শক্তি নষ্ট করে এবং শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে তাদের বিশ্ববাজারে পিছিয়ে রাখছে। এই রকম যাতায়াত একাগ্রতাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ক্লান্তি, চাপ এবং অসহিষ্ণুতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা অ্যাকাডেমিক এবং পেশাদার বিকাশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। শিক্ষার্থীদের কার্যকরভাবে প্রস্তুত করার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই পরিবহন পরিকাঠামোর উন্নতিতে বিনিয়োগ করে, যাতায়াতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যার মধ্যে শাটল ট্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানো, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অন্যতম।