ইসলামী শিক্ষার ৫ বৈশিষ্ট্য

ইসলামী শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

যুগে যুগে আলেমরা যে ইসলামী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো

১. বৈশ্বিক ও মানবিক :  ইসলামী শিক্ষা কার্যক্রমের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো তা বৈশ্বিক  ও মানবিক হবে। তার সঙ্গে সর্ব শ্রেণির মানুষের সম্পর্ক থাকবে। কেননা পৃথিবীর সব জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও বংশধারা এবং সব ভূখণ্ডের জন্য ইসলাম আগমন করেছে। ইসলাম বৈষম্যহীন অখণ্ড পৃথিবীর দাবিদার। এতে কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর বিশেষ কোনো অধিকার নেই। বিশ্বভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রেও ইসলাম পৃথিবীর কোনো শ্রেণি-গোষ্ঠীকে কারো ওপর অগ্রাধিকার দেয়নি; বরং বংশ পরিচয়ের চেয়ে আগ্রহ-উদ্দীপনা, সাড়া, অনুসন্ধান, মূল্যায়ন, প্রচেষ্টা ও গবেষণাকে বেশি মূল্য দেওয়া হয়েছে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি জ্ঞান সুরাইয়া নক্ষত্রের মধ্যে থাকত, তবে পারস্যের একদল মানুষ তা অনুসন্ধান করত।’ আল্লামা ইবনে খালদুন (রহ.) এ বক্তব্যের সমর্থনে বলেন, ‘বিস্ময়কর ব্যাপার হলো মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে বেশির ভাগ জ্ঞানের ধারক অনারব। শরয়ি (বর্ণনানির্ভর) ও আকলি (যুক্তিনির্ভর) উভয় প্রকার জ্ঞানেই তারা অগ্রগামী। অথচ মুসলিম জাতির বিকাশ হয়েছে আরব থেকে এবং শরিয়ত প্রণেতাও (নবী সা.) আরব।’

২. ব্যাপক ও বিস্তৃত : ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো তা ব্যাপক ও বিস্তৃত। কেননা ইসলামে জ্ঞানচর্চার ধারণাটিই ব্যাপক ও বিস্তৃত। মুসলমানের জন্য জ্ঞানচর্চার বাধ্য-বাধকতা, সমাজে জ্ঞানের মূল্য, কোরআন-সুন্নাহে জ্ঞানচর্চার প্রতি উৎসাহ প্রদান, মর্যাদা ও পুরস্কারের অঙ্গীকার, জ্ঞানবিমুখতার নিন্দা ইত্যাদি থেকে ইসলামে জ্ঞানচর্চার পরিধি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। ইসলামের ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে জ্ঞানচর্চার সোনালি অধ্যায় রচিত হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্র ও জনগণের সহযোগিতায় প্রত্যেক যুগেই অসংখ্য মাদরাসা ও শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রনায়কদের চেয়ে প্রত্যেক যুগের আলেমদের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। সরকারের প্রচেষ্টায় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চললেও আলেমদের প্রচেষ্টা ও স্বেচ্ছাশ্রমে ঘরে ঘরে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। যারা রাষ্ট্র, ক্ষমতা, শাসক,

নেতা ও ধনীদের থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে অমুখাপেক্ষী ছিলেন। আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে তারা অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর সব কীর্তি গড়েছেন।

মুসলমানের শিক্ষা কার্যক্রম দ্বারা সব শ্রেণি ও স্তরের মানুষ উপকৃত হতে পারে। মুসলিম ইতিহাসে জ্ঞান এত ব্যাপক ও আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল যে সর্বশ্রেণির মানুষ তা অর্জনে পরিতৃপ্তি লাভ করত। স্টেনলি লেন পুল বলেন, ‘খলিফা থেকে শুরু করে প্রতিটি মুসলিম জ্ঞান অর্জনের জন্য আগ্রহে ও তাতে অবগাহনে ব্যাকুল হয়েছিল। তাদের সবচেয়ে বড় সেবা ছিল বাগদাদের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে সর্বশ্রেণির শিক্ষার্থীকে জায়গা দিয়েছিল। ইসলামী সভ্যতার ব্যাপকতার ধারণা থেকেই এটা হয়েছিল। একই অবস্থা ছিল বিশ্বের অন্যান্য জায়গার জ্ঞানকেন্দ্রগুলোর। আরো বিস্ময়কর বিষয় হলো, সমকালীন মসজিদগুলোতেও শিক্ষার্থীদের বিপুল সমাগম ছিল। তারা আলেমদের কাছে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জন করত। বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আগ্রহ থেকেই তারা একত্র হতো।’ আর তৃণমূলে বিস্তৃত সে শিক্ষা আন্দোলনের প্রাণসত্তা ছিল জ্ঞানচর্চাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম ও ‘ইবাদত’ বলে বিশ্বাস করা।

৩. সক্রিয়তা :  সক্রিয়তা ইসলামী শিক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুসলিম সমাজে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানের ধারা কখনোই নিষ্ক্রীয় ছিল না। তা স্বল্প বা দীর্ঘ পরিসরে সক্রিয় ছিল। জ্ঞানার্জন, অধ্যয়ন, অনুসন্ধানের অনুষঙ্গ হিসেবে হাদিসের মর্যাদা, স্তর, মৌখিক বা লিখিত বিতর্ক, বিভিন্ন ভূখণ্ডে ধর্মীয় শিক্ষা ও জ্ঞানের বিস্তৃতির ধারা অব্যাহত ছিল। ইতিহাস গ্রন্থগুলোয় সক্রিয় জ্ঞানচর্চার চমৎকার সব দৃষ্টান্ত রয়েছে। আল্লামা ইবনে খালদুন (রহ.) জ্ঞানার্জনের জন্য দেশত্যাগ এবং সমকালীন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে সে উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ বিষয়ে লেখেন, ‘এর কারণ হলো মানুষ জ্ঞান, চরিত্র, মতাদর্শ ও মর্যাদা শিক্ষা-শিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করে। আবার কখনো কখনো তা সান্নিধ্য ও দীক্ষার মাধ্যমে অর্জন করে। সান্নিধ্য ও দীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত বিষয়গুলো মানুষের ভেতর দৃঢ়ভাবে বসে যায়।’ ফলে মুসলিম সমাজে জ্ঞানচর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক সান্নিধ্য ও দীক্ষার ধারা সক্রিয় রয়েছে।

৪. সাহসিকতা : আলেমরা ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজের নিষেধ এবং অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণে সব সময় সাহসী। ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে যেকোনো ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা বুক পেতে দেন। প্রয়োজনে তারা জিহাদ, সংগ্রাম, স্বাধীনতা আন্দোলন, বিদেশি আগ্রাসন ও ইসলামবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ইসলামের ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত সমাজ সংস্কারের জন্য যতবার জিহাদ (সংগ্রাম) ও ইজতিহাদ (জ্ঞানগত উদ্ভাবন)-এর প্রয়োজন হয়েছে, কোনো কোনো আলেম তার নেতৃত্বের জন্য এগিয়ে এসেছেন। তার চিন্তা ও দর্শন বৈপ্লবিক জাগরণ ও আন্দোলনের

উৎস ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। হিজরি ১৩-১৪ শতক এবং খ্রিস্টীয় ১৯-২০ শতকে মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া আর মিসর-সিরিয়া থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত যত মুসলিম দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির আগমন হয়েছে, সেসব দেশে বিদেশি শাসন ও নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের সার্বিক নেতৃত্ব আলেমদের হাতে ছিল; কমপক্ষে তারা নেতৃত্ব দানকারীদের সম্মুখ সারিতে ছিল। আলজেরিয়া ও ভারতবর্ষ তার অন্যতম দৃষ্টান্ত।

৫. উপকারী বিষয়ে গুরুত্বারোপ : ইসলাম সব সময় এমন বিষয়ের পাঠদানে গুরুত্ব দেয়, যাতে সুপথ, মুক্তি, পরকালীন কল্যাণ নিহিত। তা এমন শিক্ষা, যার ওপর মানুষের সৌভাগ্য ও মুক্তি নির্ভরশীল, যার মাধ্যমে তার সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা, জগত্গুলো পরিচালনাকারীর সত্তা ও গুণাবলি সম্পর্কে অবগত হবে। কোরআনে সেসব মানুষের নিন্দা করা হয়েছে তাদের জ্ঞানচর্চার পুরো পার্থিব জীবনকেন্দ্রিক। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, আমি কি তোমাদের সংবাদ দেব কর্মে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্তদের? তারাই সেসব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পণ্ড হয়, যদিও তারা মনে করে যে তারা সৎকর্মই করছে। তারাই সেসব লোক, যারা অস্বীকার করে তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলি ও তাঁর সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের বিষয়। ফলে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায; সুতরাং কিয়ামতের দিন তাদের জন্য ওজনের কোনো ব্যবস্থা রাখব না।’ (সুর কাহফ, আয়াত : ১০৩-১০৫)

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *